Khoborerchokh logo

তোমার জন্ম হয়েছিল বলে, আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশ ।। 220 0

Khoborerchokh logo

তোমার জন্ম হয়েছিল বলে, আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশ ।।

টিটু সরকারঃ 
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাংলার রাখাল রাজা। যার জ্বালাময়ী ভাষণে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছিল। গতকাল ১৭মার্চ বুধবার তার ১০১ তম জন্মদিন সারা দেশে পালন হয়েছে। জাতির পিতার জন্মদিনে তার জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় তুলে ধরলাম।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বাবা লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৪ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৃতীয়। মা বাবা তাকে খোকা বলে ডাকতেন। 
১৯২৭ সালে সাত বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। নয় বছর বয়সে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। ছাত্র অান্দোলন ও রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার অাগে তিনি অন্য পাঁচ দশজন কিশোরের মতো খেলার মাঠকেই ভালোবাসতেন। ফুটবলের প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো অপরিসীম। একজন মেধাবী ফুটবলার হিসেবে কৈশোরে অসামান্য খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলায় তিনি নিয়মিত পুরস্কৃত হতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ বছর বয়সে শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেনুকে বিয়ে করেন। তার ঘরে জন্ম নেন দুই কন্যা শেখ হাসিনা,  শেখ রেহানা এবং তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল।
১৯৪২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেই বছরই তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে এই কলেজ থেকেই তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন।
১৯৪৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন পর্যন্ত তিনি তাঁর দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে যান।
১৯৪৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের ১৬ অাগস্ট কুখ্যাত ক্যালকাটা কিলিং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং শান্তি বজায় রাখতে ঝাঁপিয়ে পড়েন, নিজের জীবন বাজি রেখে হিন্দু, মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ লোকদের জীবন রক্ষা করেন।
১৯৪৭ সালে মিশন চলাকালীন সময়ে গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে অান্দোলনে যোগ দেন। যদিও উদ্যোগটি বাতিল হয় তবে পরবর্তী সময়ে এটিই স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি হয়।
১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিদ্যালয়ে অাইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গণপরিষদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অবশ্যই উর্দুকে মানতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে এই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান অান্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কাজ শুরু করেন। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় কয়েকজন সহকর্মীসহ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্র সমাজের অব্যাহত অান্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুসলিম লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকলকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। 
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা বিধান ও অধিকার অাদায় অান্দোলনের সমর্থন করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯ এপ্রিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে মিছিল বের করার প্রস্তুতির সময় কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ শেখ মুজিবুর রহমানকে উপাচার্যের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান অাওয়ামী মুসলিম লীগ বর্তমান অাওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কারা বন্দী অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। 
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। জেলে বন্দী অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা অান্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং অান্দোলনকে সফল করার জন্য জেল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাঠাতেন। ১৬ জানুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান জেলের ভেতরেই টানা ১১ দিন অামরণ অনশন চালিয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট অাহ্বান করেন। অান্দোলনরত ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ অারো অনেকে। জেল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান শহীদদের প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানান। একই বছর শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন সফর করেন। শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তৃতা দেন, ভাষা অান্দোলনকে নিয়ে যান বৈশ্বিক অঙ্গনে।
১৯৫৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান অাওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং একজন বাঙালি নেতা হিসেবে তাঁর উত্থান হয়।
১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি অাসনের মধ্যে ২২৩টি অাসনে জয়লাভ করে। অাওয়ামী লীগ একাই ১৪৩টি অাসনে জয়ী হয়। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ অাসন থেকে নির্বাচিত হন এবং ১৫ মে নতুন প্রাদেশিক সরকারের বন ও কৃষি মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২৯ মে ভারত স্বাধীনতা অাইন ১৯৪৭ প্রয়োগ করে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভা ভেঙে দেয়। ৩০ মে শেখ মুজিবুর রহমান করাচি থেকে ঢাকা অাসা মাত্রই গ্রেফতার হন। ২৩ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। 
১৯৫৫ সালে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সকল ধর্মের মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে রাখা অাওয়ামী লীগ। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর অাওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় অাওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। 
১৯৫৬ সালে খান অাতাউর রহমানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকারে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। মাত্র নয় মাস তিনি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। অাওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাঙালির অধিকার অাদায় অান্দোলনকে বেগবান করা এবং সংগঠনকে অারো সুসংহত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। 
১৯৫৭ সালের ১৩-১৪ জুন অাওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় অাওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২৪ জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত তিনি সরকারি সফরে চিনে যান।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল অাইয়ুব খান  সামরিক শাসন জারি করেন এবং সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেন। ১১ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।  একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে হয়রানি করা হয়। ১৪ মাস পর মুক্তি পাওয়ার পর জেলগেট থেকেই পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। 
১৯৬১ সালে হাইকোর্ট কর্তৃক অাটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করার পর শেখ মুজিবুর রহমান কারা মুক্ত হন। তখনই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য উদ্যমী ছাত্র নেতৃবৃন্দদের নিয়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। 
১৯৬২ সালে অাইয়ুব সরকার ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে পুনরায় গ্রেফতার করে। ২ জুন চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৮ জুন শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান। ২৪ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর যান এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে অন্যান্য বিরোধীদলকে সাথে নিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেন। 
১৯৬৪ সালে ২৫ জানুয়ারি জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নং বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সভায় অাওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই অধিবেশনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থেকে অালাদা হয়ে অাওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র দল হিসেবে অাবির্ভূত হয়। ৬-৮ মার্চ কাউন্সিল মিটিং-এ দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সম্বলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় মাওলানা অাবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়।  দাঙ্গার পর শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সেনাশাসক অাইয়ুব খান বিরোধী ঐক্যবদ্ধ অান্দোলনের প্রস্তুতি নেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধী দল বা কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৪ দিন অাগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। 
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোর বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা দাবি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এই ছয় দফা মুক্তিকামী বাঙালি জাতির জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির বীজ বুনে দেয়, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ায় অাঘাত করে। ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান অাওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি সারা বাংলায় বিচরণ করেন। এসময় তাকে অাটবার গ্রেফতার করা হয় এবং সর্বশেষ ৮ মে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। প্রায় তিন বছর তিনি কারা বরন করেন।
১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি অাইয়ুব সরকার রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সরকারি অফিসার মোট ৩৫ জন বাঙালির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহীতার অভিযোগ এনে অাগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে।  জেলে বন্দী অবস্থাতেই তাঁর উপর পুনরায় গ্রেফতার অাদেশ জারি হয়। ভারতের সহায়তায় পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে ১ নম্বর অাসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য মামলা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ অাগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মাঝে অাগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। 
১৯৬৯ সালে অাগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ছাত্র গণঅান্দোলন শুরু হয়। টানা অান্দোলনের মুখে অাইয়ুব সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ অাগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকলকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বিশাল ছাত্র সমাবেশে লাখো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত করে। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অায়োজিত অাওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখেন বাংলাদেশ। 
১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে অাওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীকে অাহ্বান করেন। অাওয়ামী লীগের জন্য তিনি নৌকা প্রতীক বেছে নেন। ১২ নভেম্বর ঘুর্ণিঝড়ে উপকূল এলাকায় লাখো মানুষ মারা যায়। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত করে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় ছুটে যান। ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে অাওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়। ১৬৯টি অাসনের ১৬৭টি অাসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি অাসনের মধ্যে সংরক্ষিত ১০টি মহিলা অাসনসহ মোট ২৯৮টি অাসনে অাওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। 
১৯৭১ সালে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর দুই দিন অাগে অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় সর্বস্তরের বাঙালি জনতা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অাকাঙ্ক্ষা নতুন মোড় নেয়। ১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু কার্যত ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান। একদিকে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার নির্দেশ যেত, অন্যদিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে যেত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। বাংলার মানুষ মেনে চলতেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন এবারের সংগ্রাম অামাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।  ঐতিহাসিক এভাষনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতির অাহ্বান জানান। এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অাসেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে ১৬-২৪ মার্চ পর্যন্ত দফায় দফায় অালোচনা চললেও ফলপ্রসূ সমাধান অাসেনি। ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির উপর পাক হানাদার বাহিনী ইতিহাসের ঘৃণিত হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় এবং গণপরিষদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের অম্রকাননে বর্তমানে মুজিবনগর বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর অাত্মসমর্পণের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। অাগস্ট এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে পাকিস্তান জেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার করে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা দাবি করেন। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়। 
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি অন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সেদিনই তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন যাত্রা করেন। এবং লন্ডন হোটেলে অবস্থানকালে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব মিডিয়ার মুখোমুখি হন। ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে দেখা করেন। ঢাকায় ফেরার অাগে নয়াদিল্লিতে কিছু সময় তিনি অবস্থান করেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিমান বন্দরে সাদর অভ্যর্থনা জানান। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে ফিরে অাসেন। সেদিন বাঙালি জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জানায়। লক্ষ জনতার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় স্নাত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিমান বন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে অাসেন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুর্নগঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন বাংলাদেশের শক্ত ভিত্তি স্থাপন করেন। এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর পুনর্বাসন, স্বাধীন হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ফেরত পাঠানো, দশ মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, একশোরও বেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি অাদায়, জাতিসংঘ, ন্যাম, ওঅাইসি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ইত্যাদি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। 
১৯৭৩ সালে নব প্রণীত সংবিধানের অালাকো, ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অাওয়ামী লীগ ৩০০টি অাসনের মধ্যে ২৯৩টি অাসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। ২৩মে বিশ্ব শান্তিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি পুরস্কারে ভূষিত করে। ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে অালজেরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। অালজেরিয়ায় বিশ্বনেতৃবৃন্দের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিপাক্ষিক অালোচনা অনুষ্ঠিত হয়। 
১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তব্য রাখেন। এর মাত্র সাতদিন আগে ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ববাসীর অকুন্ঠ সমর্থন পেয়ে ১৩৬তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। 
১৯৭৫ সালের ১৫ অাগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশী বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। ১৯৭৫ সালের ১৫ অাগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্ধকারতম দিন। বাঙালি জাতি এই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে এবং সাথে সাথে স্মরণ করে বিশাল হৃদয়ের সেই মহাপ্রাণ মানুষটিকে যিনি তাঁর সাহস, শৌর্য, আদর্শের মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাঙালি জাতির অন্তরে।


সম্পাদকঃ আলমগীর কবীর, ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মনিরুজ্জামান। উপদেষ্টা সম্পাদক পরিষদঃ শাহিন বাবু । অস্থায়ী কার্যালয়ঃ নাওজোড়, বাসন, গাজীপুর মেট্রো পলিটন, গাজীপুর।
যোগাযোগঃ ০১৭১১৪২১৪৫১, ০১৯১১৮৮৯০৯৩, ই-মেইলঃ khoborersomoy24@gmail.com, web: www.khoborersomoy.com